লাইলাতুল কদর ও এ রাতের করণীয়?
পবিত্র কোরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর কদরের রাত সম্পর্কে তুমি কী জান? কদরের রাত সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তি বিরাজ করে ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই এ জায়গাটিতে এসে পৃথিবীর যেকোনো বিবেকবান, সজাগ ও সচেতন মানুষ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়াবে। একটি রাতÑ যে রাতের মূল্য আল্লাহ জাল্লা জালালুহুর কাছে হাজার মাসের চাইতে উত্তম। অর্থাৎ তিরাশি বছরেরও বেশি সময় থেকে উত্তম। এ রাতটি যদি কোনো ব্যক্তি ইবাদত বন্দেগি ও সৎ কল্যাণ সাধনার ভেতর দিয়ে পালন করতে পারে তাহলে সে ব্যক্তি যেন তিরাশি বছরেরও বেশি সময় সৎ ও কল্যাণ সাধনার ভেতর দিয়ে পার করল। এটা খুব সহজ কথা নয়। আমরা যারা এ মাটির পৃথিবীতে বাস করি আমরা খুব ভালো করে জানি একজন ব্যক্তি একটি মাসও নিশ্চিদ্রভাবে কল্যাণ কর্মের ভেতর দিয়ে পার করতে পারে না। তাকে নানা রকমরে বাঁধা ও প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে পার করতে হয়। নানা রকমের অন্যায়ের ভেতরে পড়তে হয় ইচ্ছায় কী অনিচ্ছায়। কিন্তু একটি রাতে যদি কোনো মানুষ স্বপথে বলিয়ান হয় এবং সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়—রাতটি সে ভালোর ভেতর দিয়ে কাটাবে তাহলে এটা কোনো অস্বাভাকি বিষয় নয়। অথচ আল্লাহ জাল্লা জালালুহু সুযোগ করে দিয়েছেন যদি কেউ এ রাতটি কল্যাণ কামনার ভেতর দিয়ে কাটাতে পারে সে এ কল্যাণের অধিকারী হতে পারে। এক মহা সুযোগ মানুষের জন্য এ রজনীটি।অপরদিকে এ রাতে অজ¯্র ধারায় আল্লাহর খাস রহমত বর্ষিত হয়। এ রাতে এত অধিকসংখ্যক রহমতের ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করেন যে, সকাল না হওয়া পর্যন্ত এক অনন্য শান্তি বিরাজ করতে থাকে। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, শবে কদরে হযরত জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট এক দল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাযরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে, তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে কদরের রাতে দ-ায়মান হয়, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। একজন সচেতন, একজন পরকাল বিশ^াসী এবং নিজের জীবনের সফলতার স্বপথে বলিয়ান মানুষের জন্য এ যে কত বড় কল্যাণের বার্তা ও নিমন্ত্রণ তা আমরা স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করে কুলিয়ে উঠতে পারব না। কবে এ রজনী?যে রাতটি লাইলাতুল কদর হবে, সেটি বোঝার কিছু আলামত হাদীসে বর্ণিত আছে। সেগুলো হলো— ১. এ রাতটি রমযান মাসে নিহিত। ২. এ রাতটি রমযানের শেষ দশকে রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অর্থ : রমযানের শেষ দশদিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ করো। ৩. এটি রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অর্থ : তোমরা রমযানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত খোঁজ করো। ৪. এ রাত রমযানের শেষ সাত দিনে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ৫. রমযানের ২৭ রজনী লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। উবাই ইবনে কাব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের যে রজনীকে ‘কদরের রাত’ হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা হলো রমযানের ২৭ তম রাত। ৬. কদরের রাত হওয়ার ব্যাপারে সম্ভাবনার দিক থেকে পরবর্তী দ্বিতীয় সম্ভাবনা ২৫ তারিখ, তৃতীয় ২৯, চতুর্থ ২১ এবং পঞ্চম হলো ২৩ তারিখের রজনী। ৭. সর্বশেষ আরেকটি মত হলো, মহিমান্বিত এ রজনীটি স্থানান্তরশীল। অর্থাৎ প্রতিবছর একই তারিখে বা একই রজনীতে তা হয় না এবং শুধু ২৭ তারিখেই এ রাতটি আসবে তা নির্ধারিত নয়। আল্লাহর হেকমত ও তাঁর ইচ্ছায় কোনো বছর তা ২৫ তারিখে, কোনো বছর ২৩ তারিখে, কোনো বছর ২১ তারিখে, আবার কোনো বছর ২৯ তারিখেও হয়ে থাকে। ৮. রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না এবং নাতিশীতোষ্ণ হবে। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না। ৯. মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে এবং সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে। ১০. কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়েও দিতে পারেন। ১১. ওই রাতে বৃষ্টি হতে পারে। ১২. সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো। এই রাতকে লাইলাতুল কদর বলা হয় কেন?শব ফারসি শব্দ, এর অর্থ রাত। আর কদর অর্থ নিবারণ করা বা মর্যাদা। পবিত্র কোরআনে রাতটিকে নাম দেওয়া হয়েছে লাইলাতুল কদর। আরবী লাইলাতুন অর্থ রাত। তাহলে শবে কদর বা লাইলাতুল কদরের অর্থ দাঁড়ায় নিবারণের রাত বা মর্যাদার রাত। এ রাতে মহান আল্লাহ সৃষ্টিকুলের আগামী এক বছরের ভাগ্যলিপি ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করেন, সে জন্য অথবা যেসব ব্যক্তি নিজেদের গুনাহর কারণে মূল্যহীন ছিল, তারা এ রাতের ইবাদত-বন্দেগি আর তাওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে মহান আল্লাহর দরবারে উঁচু মার্যাদার অধিকারী হন বলেই এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে ‘শবে কদর’ বা ‘লাইলাতুল কদর’। এ রাতের ফজিলতআল্লাহ তাআলা বলেন, অর্থ : রমযান মাস হলো সেই মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে আল-কোরআন, যা মানব জাতির জন্য হেদায়াত ও সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন নাজিল হওয়ার কারণে অন্যসব মাস ও দিনের চেয়ে রমযান মাস বেশি ফজিলতময় হয়েছে। আর রমযানের রাতগুলোর মধ্যে কোরআন নাজিলের রাত—লাইলাতুল কদর সবচেয়ে তাৎপর্যম-িত একটি রাত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, অর্থ : আমি একে নাজিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জান কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ আয়াতের ব্যাখায় মুফাসসিরকুল শিরোমণি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, ‘এ রাতের ইবাদত অন্য হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম’। তাবেঈ মুজাহিদ (রাযি.) বলেন, এর ভাবার্থ হলো, ‘এ রাতের ইবাদত, তেলাওয়াত, কিয়াম ও অন্যান্য আমল লাইলাতুল কদর ছাড়া হাজার মাস ইবাদতের চেয়েও উত্তম।’ মুফাসসিররা এমনই ব্যাখ্যা করেছেন। আর এটিই সঠিক ব্যাখ্যা। সূরা কদরের শানে নুজুল সম্পর্কে ইবনে কাসির (রাযি.) বলেন, আলী ইবনে উরওয়া (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনি ইসরাঈলের চারজন আবেদ সম্পর্কে বলেছিলেন, তারা আশি বছর ধরে অনবরত আল্লাহর ইবাদত করছিল। এর মধ্যে মুহূর্ত সময়ের জন্যও ইবাদত থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হননি। বিখ্যাত এ চারজন আবেদ হলো আল্লাহর নবী জাকারিয়া (আ.), আইউব (আ.), হাজকিল ইবনে আ’জূজ (আ.) এবং ইউশা ইবনে নূহ (আ.)। এমনটি শুনে সাহাবীরা (রাযি.) রীতিমতো অবাক হলেন। এ সময় জিবরাঈল (আ.) এসে বললেন, ‘হে মুহাম্মদ! আপনার উম্মতরা এ কথা শুনে অবাক হচ্ছে? তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা এর চেয়ে উত্তম কিছু রেখেছেন। এরপর সূরা কদর পাঠ করা হয়। কদরের রাতের খোঁজে...একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনি ইসরাঈলের একজন মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, তিনি এক হাজার বছর দীর্ঘ হায়াত পেয়েছিলেন। দীর্ঘ এ আয়ুষ্কাল তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে রত ছিলেন। একবারের জন্যও অস্ত্র সংবরণ করেননি। সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) ঘটনা শুনে বিস্মিত হলেন এবং আফসোস করতে লাগলেন যে, বনি ইসরাঈল সুদীর্ঘ হায়াত পাওয়ার কারণে অনেক বেশি ইবাদত-বন্দেগি করতে পেরেছে। অনেক সওয়াব অর্জন করতে পেরেছে। আমাদেরও যদি তাদের মতো দীর্ঘ হায়াত দেওয়া হত, তাহলে আমরা তাদের মতো অনেক ইবাদত করতে পারতাম, অনেক বেশি পুণ্য লাভ করতে পারতাম। এ সময় মহান আল্লাহ সূরা কদর নাজিল করেন এবং বুঝিয়ে দেন যে, যদিও উম্মতে মুহাম্মদিকে হায়াত কম দেওয়া হয়েছে, তথাপি তাদের সওয়াব হাসিলের ও মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের এত বেশি সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা পূর্ববর্তী কোনো উম্মতকে দেওয়া হয়নি। উম্মতে মুহাম্মদি যদি শুধু একটি রাত (লাইলাতুল কদর) ইবাদত করে, অর্থ : তাহলে তারা এক হাজার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশি সওয়াবপ্রাপ্ত হবে। হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,অর্থ : তোমরা রমযান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো।’ তবে রমযান মাসের ২৭তম রাতটি শবে কদর হিসেবে বিশেষভাবে সমগ্র মুসলিম সমাজে পালিত হয়। আর ব্যাপক প্রসিদ্ধ এ মতটিও হাদীস দ্বারা সমর্থিত। কদরের রাত ইবাদতের রাত। তবে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদতের জন্য রাতটি নির্ধারিত নয়। যে কোনো ইবাদতই এ রাতে করা যেতে পারে। নফল নামায, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, ইস্তেগফারসহ যেকোনো ইবাদতই করা যেতে পারে। সালাতুত তাসবিহ শবে কদরের জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট না হলেও যেহেতু এ নামায আদায়ে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়, আর লাইলাতুল কদরে সারা রাতই অধিকাংশ মুসলমান জেগে থাকেন, তাই কদরের রাতে সালাতুত্ তাসবিহ আদায় করা যেতে পারে। এ রাতটি কীভাবে কাটাতে হবে? এ মহা সৌভাগ্যের রাতটি কীভাবে কাটাতে হবে, কীভাবে পাব, কীভাবে সেটাকে আমরা অধিকার করব তার পথ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এঁকে দেখিয়েছেন। তিনি রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য ইতেকাফ করেছেন। ইতেকাফ করে তিনি উম্মতকে শিখিয়েছেন কীভাবে সহজে নিশ্চিন্তে লাইলাতুল কদর অর্জন করতে হয়। তুমি যদি লাইলাতুল কদরকে দখল করতে চাও, অধিকার করতে চাও, তার সমূহ কল্যাণ তোমার জীবনে তুলে আনতে চাও তাহলে সহজ পথ হচ্ছে লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্যে তুমি মসজিদে এসে ইতেকাফ করো। এর ভেতর দিয়ে তিরাশি বছর একাধারে ইবাদত করলে যে পুণ্য অর্জিত হবে এক রাতের ভেতর দিয়েই তা অর্জিত হবে।যদি বিষয়টি সহজভাবে দেখি, একজন মানুষ তার জীবনের ষাট বা সত্তর বছর কাটিয়েছে। কিন্তু সে এ ষাট বা সত্তর বছরে সতর্ক সাধনার ভেতর দিয়ে পেয়েছে মাত্র দু’টো কদর। যদি আমরা সহজ অঙ্কেও চিন্তা করি তাহলে সে এ দু’টো ইতেকাফের মাঝ দিয়ে একশ সত্তর বছরের কাছাকাছি সময় একাধারে নিñিদ্র ইবাদতের ভেতর দিয়ে কাটিয়ে দিলো। এটা কোনো সহজ কিংবা স্বাভাবিক কোনো কথা নয়। আল্লাহ তাআলা বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করার তাওফিক দিন। আরও পড়ুন: যাকাত না দেওয়ার পরিণাম ও শাস্তি